Monday, September 23, 2013

হেপাটাইটিস বি

হেপাটাইটিস বি বলতে বুঝায় হেপাটাইটিস বি ভাইরাসের আক্রমে লিভারে প্রদাহ (inflammation) কে।

ভয়াবহতাঃ
আমাদের দেশের শতকরা ৪-৭% (প্রায় ৬৪ লাখ থেকে ১ কোটি)মানুষ হেপাটাইটিস বি এর বাহক। দেশের প্রায় ৩.৫% গর্ভবতী মহিলারা এই ভাইরাসে আক্রান্ত হন। মনে রাখতে হবে যে হেপাটাইটিস বি ভাইরাস এইডস ভাইরাসের থেকে ১০০% বেশী সংক্রামক। বিশ্বে প্রতিদিন যে পরিমান মানুষ এইডস এ মারা যায়, তার দ্বিগুন মারা যায় হেপাটাইটিস বি তে।

সংক্রমনঃ
এই রোগ এর সংক্রমন ঘটে আক্রান্ত ব্যক্তির লালা, রক্ত, বীর্য, যোনীরস ইত্যাদির মাধ্যমে। সুতরাং আক্রান্ত ব্যক্তির সাথে একই টুথব্রাশ-রেজর ব্যবহার, যৌনসঙ্গম, আক্রান্ত ব্যক্তির কাছ থেকে রক্তগ্রহন অথবা তার ব্যবহৃত সিরিঞ্জ বা সুই ব্যবহারের মাধ্যমে আপনি আক্রান্ত হতে পারেন। সুতরাং, আপনার জানা মতে কারো হেপাটাইটিস বি আছে জানলে এসব ব্যাপারে সতর্ক থাকুন। এছাড়া হেপাটাইটিস বি আক্রান্ত মায়ের কাছ থেকে গর্ভের সন্তান ও আক্রান্ত হয়। মনে রাখবেন সাধারণ ছোয়া, সাধারণ চুম্বন, একই থালা-বাটি (ধোয়া) ব্যবহার, বুকের দুধ, সর্দি-কাশির মাধ্যমে এই রোগ ছড়ায় না।

ধরণঃ
>হেপাটাইটিস বি দ্বারা সংক্রমিত হওয়ার পর, আপনার শরীরের সাধারণ রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তখন হেপাটাইটিস বি ভাইরাসের সাথে যুদ্ধ করে তা হটাতে চেষ্টা করবে। সাধারণত মাসখানেক এর মধ্যেই (সবেচেয়ে খারাপ ক্ষেত্রে ৬ মাস এর মধ্যে) সে সফল হয়ে যাবে এবং আপনি সম্পূর্ণ সুস্থ্য হয়ে যাবেন। আপনার শরীরে ভাইরাসটির সাথে যুদ্ধ করার মত সরঞ্জাম তৈরী হয়ে গিয়েছে, তাই আপনি আর কখনো এই ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হবেন না। এই ধরণের রোগকে বলা হয় acute hepatitis।
> অনেক ক্ষেত্রে সে সফল হবেনা এবং এই ভাইরাস আপনার শরীরে পাকাপোক্ত হয়ে বসবে। একে বলা হয় chronic hepatitis। chronic hepatitis এর রোগীদের অনেকের বছরের পর বছর কোন লক্ষনই থাকেনা, তাই তারা জানেই না যে তার এই ভাইরাসে আক্রান্ত। অথচ নিজের অজান্তে সে অন্যদের মাঝে এই ভাইরাস ছড়িয়ে দিতে থাকে। পাশাপাশি নিজের অজান্তেই তার লিভার ক্ষতিগ্রস্ত হতে থাকে এবং কার্যক্ষমতা হারাতে থাকে। কখনো তা লিভার সিরোসিস বা ক্যান্সারে পরিণত হয়য়। নবজাতকেরা যদি হেপাটাইটিসে আক্রান্ত হয়, যেহেতু তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দূর্বল, ৯০ ভাগ ক্ষেত্রেই তা chronic hepatitis এ রপান্তরিত হয়। বাচ্চাদের ক্ষেত্রে chronic hepatitis রুপান্তরিত হওয়ার হার ৬০% এবং পূর্নবয়স্কদের জন্য ১০%।

লক্ষনঃ
>Acute Hepatitis এ, ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার ৬ সপ্তাহ থেকে ৬ মাসের মধ্যে নিম্নের লক্ষন গুলো দেখা দেয়-
1. হালকা জ্বর
2. দুর্বলতা
3. হলুদাভ ত্বক ও চোখ
4. অরুচি
5. বমি বমি ভাব থাকা বমি হওয়া
6. মাংসপেশী বা জয়েন্ট এ ব্যথা
7. কালচে মুত্র
8. কাদার মত মল
>Chronic Hepatitis এর রোগীদের বেশিরভাগেরই কোন লক্ষন ই থাকেনা। কিন্তু ধীরে ধীরে তাদের লিভার ড্যামেজ হতে থাকে। বাকীদের লক্ষন উপরের মতই।

টেস্টঃ
ELISA, Liver Function Test, Albumin Test, Prothrombin time ইত্যাদির মাধ্যমে সহজেই শরীরে হেপাটাইটিস বি ভাইরাস দ্বারা সংক্রমনের প্রমাণ পাওয়া যায়। যারা chronic hepatitis এ ভুগছেন, লিভার বায়োপসির মাধ্যমে জানা যায় যে, তাদের লিভার ভাইরাস দ্বারা কতটুকু ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

চিকিৎসাঃ
> Acute hepatitis B: এই ক্ষেত্রে আপনার শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাই ভাইরাসের সাথে যুদ্ধ করতে থাকে। আপনার আলাদা কোন ওষুধের প্রয়োজন নেই।আপনাকে শুধু বিশ্রাম নিতে হবে, পর্যাপ্ত পানীয় এবং স্বাস্থ্যকর খাবার খেতে হবে।
>Chronic hepatitis B: এই ক্ষেত্রে ডাক্তার এন্টি-ভাইরাল ওষুধ (peginterferon) দিবেন যা আপনার দীর্ঘদিন খেতে হবে। এই ওষুধ ধীরে ধীরে আপনার শরীরে ভাইরাসের মাত্রা কমিয়ে আনবে। নিয়মিত ডাক্তারের তত্ত্ববধানে থাকতে হবে যাতে জানতে পারেন যে আপনার শরীরে ভাইরাস এখন কি অবস্থায় আছে। মনে রাখবেন, আপনার শরীরে কোন অসুস্থতার লক্ষন না থাকলেও আপনার লিভারকে বাচানোর জন্য এবং অন্যকে সংক্রমনের মাত্রা কমানোর জন্য আপনাকে ওষুধ খেয়ে যেতে হবে। মদ্যপান থেকে বিরত থাকতে হবে। যে কোন ওষুধ খাওয়ার আগে ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে, এমন কি সাধারণ প্যারাসিটামল বা কোন হার্বাল ওষুধ হলেও। এই অবস্থার কোন স্পেশাল ডায়েট নেই।
>Acute বা Chronic hepatitis B এ আক্রান্ত হয়ে যাওয়ার পর ভ্যাকসিন দিলে আপনি সুস্থ্য হবেন না বা আপনার লিভার ভাইরাসের দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া থেকে বাচবে না। যতদিন শরীরে ভাইরাস থাকবে লিভার ক্ষতিগ্রস্ত হতে থাকবে এবং যদি লিভার অকার্যকর হয়ে পড়ে তাহলে একমাত্র চিকিতসা হলো, লিভার প্রতিস্থাপন। সুতরাং-1.রোগ হওয়ার আগেই ভ্যাকসিন নিন 2. Acute hepatitis হলে পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিন এবং 3. Chronic hepatitis হলে অবশ্যই ডাক্তারের তত্তাবধানে থাকুন।

প্রতিরোধঃ
>বাচ্চারা জন্মের সাথে সাথেই হেপাটাইটিস বি টীকার প্রথম ডোজ ও ৬-১৮ মাসের মধ্যে দ্বীতিয় ও তৃতীয় ডোজ নিতে পারে।
>যেসব বাচ্চার মায়ের acute বা chronic hepatitis B আছে, তাদের জন্মের ১২ ঘন্টার মধ্যে একটি স্পেশাল ভ্যাকসিন (hepatitis B immune globulin বা HBIG) নিতে হবে।
>কেউ জন্মের পর ভ্যাকসিন না নিলে ১৮ বছর বয়সের আগে catch-up ভাকসিন বা এই বয়স পার হয়ে গেলে adult vaccine নিতে পারেন। ৩ ডোজের এই ভ্যাকসিন শতভাগ কার্যকরী এবং ১৯৮২ সালে আবিষ্কারের পর থেকে ১০০ মিলিয়ন মানুষের উপর প্রয়োগ করে কোন প্বার্শ-প্রতিক্রিয়ার কথা জানা যায়নি। তবে যাদের ইস্টে এলার্জি আছে তারা এটি নিতে পারবেন না। হেপাটাইটিস বি ভাকসিন এখন দেশের অনেক জায়গাতেই দেওয়া হয়। তিন ডোজ মিলিয়ে আনুমানিক খরচ ২৫০০ টাকা (লিভার ফাউন্ডেশন এর তথ্য মতে)
>যারা সংক্রমিত হওয়ার সাথে সাথে টের পেয়েছেন, তারা ২৪ ঘন্টার মধ্যে হেপাটাইটিস ভ্যাকসিন অথবা স্পেশাল ভ্যাকসিন (HBIG) নিতে পারেন।
>যাদের স্বামী বা স্ত্রীর chronic hepatitis B আছে বা ডাক্তার-নার্স, যারা নিয়মিত হেপাটাইটিস রোগীর সংস্পর্শে আসেন, তারা হেপাটাইটিস বি ভ্যাকসিন নিয়ে রাখুন।
>যে কোন রক্ত নেয়ার আগে পরীক্ষা করে নিন।
>সিরিঞ্জ ব্যবহারে সবসময় নতুন সুই ব্যবহার করুন।
>ট্যাটু করার আগে নতুন সুই ব্যবহার করুন।
>আপনার স্বামী বা স্ত্রীর acute বা chronic hepatitis Bথাকলে নিরাপদ মিলনে (কন্ডোম ব্যবহার করে) অভ্যস্ত হোন.
>সংক্রমিত ব্যক্তির কোথাও কেটে গেলে, এক ভাগ ব্লিচ এর সঙ্গে ৯ ভাগ পানি মিশিয়ে তা দিয়ে পরিষ্কার করুন। পরিষ্কার না করলে এমনি আধা শুকনো কাটা থেকেও অন্যেরা সংক্রমিত হতে পারে।
>সংক্রমিত ব্যাক্তির সাথে একই টুথব্রাশ-রেজার ব্যবহার করবেন না।
>সংক্রমিত ব্যক্তি কখনোই রক্তদান করবেন না।

No comments:

Post a Comment